লিউকেমিয়া কি?

রক্তের ক্যান্সার নামক এই মারাত্মক রোগ বিশ্বজুড়ে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন মানুষের দেহে ২০১৫ সালে ধরা পড়েছে, এবং এই বছরেই ৩৫৩,৫০০ জন মারা গিয়েছেন। লিউকেমিয়ার চিকিৎসা জটিল হতে পারে, এর ধরন এবং অন্যান্য বিভিন্ন কারণের কারণে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত পাঁচ বছরের সার্ভাইভাল রেট ছিল ৬৭%, যদিও উন্নত বিশ্বের অন্যান্য দেশে শিশুদের ক্ষেত্রে এই হার ৬০% থেকে ৯০% পর্যন্ত যেতে পারে।

রক্ত ক্যান্সার নির্ণয়ের প্রক্রিয়াটি রোগের লিউকেমিয়ার ধরনের উপরেও নির্ভর করে। অস্থিমজ্জা এবং রক্তের এই বিশেষ ধরণের ম্যালিগন্যান্ট ক্যান্সার হলে শ্বেত রক্তকণিকাগুলির অস্বাভাবিক পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা তাদের নিয়মিত কাজে বাধা দেয়। যদিও রোগের বংশগত ও পরিবেশগত কারণগুলি চিহ্নিত করা সম্ভব, আরও অনেক ঝুঁকির কারণ যেমন ধূমপান, কেমিক্যালের সংস্পর্শে আসা এবং বিশেষ ভাইরাসের কারণে হতে পারে। অনেক রোগীই যে কোনো ঝুঁকির কারণ ছাড়াই লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

লিউকেমিয়ার সংজ্ঞা

রক্তের ক্যান্সার হিসেবে পরিচিত লিউকেমিয়া, শ্বেত রক্তকণিকা জনিত ক্যান্সার যা অস্থিমজ্জা এবং লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমে অস্বাভাবিক কোষের বিস্তার ঘটায়। এই ম্যালিগন্যান্ট রোগটি বিভিন্ন ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা অপরিপক্ক ও ক্ষতিকর হয়ে ওঠে, যা স্বাভাবিক রক্ত উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।

লিউকেমিয়া কি ধরনের রক্তের ক্যান্সার?

লিউকেমিয়া প্রধানত উৎপত্তি হয় অস্থিমজ্জা থেকে, যেখানে শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি হয়। এই শ্বেত রক্তকণিকাগুলো যখন অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায়, তখন তারা রক্তের ক্যান্সারের কারণ হয়। এই অস্বাভাবিক কোষগুলো ম্যালিগন্যান্ট হয়ে অন্যান্য স্বাস্থ্যকর কোষগুলির বিকাশকে ব্যাহত করে থাকে।

আরও পড়ুনঃ  গ্যাস ব্যথা দূর করার উপায় - সহজ টিপস

লিউকেমিয়া কীভাবে সৃষ্টি হয়?

লিউকেমিয়ার সৃষ্টির প্রধান কারণগুলো হলো জেনেটিক এবং পরিবেশগত ফ্যাক্টর। অস্থিমজ্জায় জেনেটিক পরিবর্তনের ফলে শ্বেত রক্তকণিকা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায় এবং অস্বাভাবিক কোষ তৈরি হতে থাকে। এছাড়া, রেডিয়েশন অথবা ক্যামিকাল এক্সপোজারের মতো পরিবেশগত কারণগুলিও এই ধরণের ক্যান্সার ঘটাতে পারে।

লিউকেমিয়ার উপসর্গ

লিউকেমিয়া, এক ধরনের রক্তের ক্যান্সার, যা অস্থি মজ্জায় শুরু হয়ে রক্ত তৈরির প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে। লিউকেমিয়ার লক্ষণ অত্যন্ত বিচিত্র এবং মারাত্মক হতে পারে, যা রোগের পর্যায় অনুযায়ী ভিন্নতা প্রকাশ করে।

সাধারণ উপসর্গগুলি কি কি?

  • রক্তক্ষরণের সমস্যা, যেমন নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়া বা লাল পোঁদড়া উপস্থিতি।
  • বারবার সংক্রমণ হওয়া, যা পুনরাবৃত্তিমূলক এবং গুরুতর হতে পারে।
  • কালশিটে যা শরীরের বিভিন্ন অংশে কালো দাগ হিসেবে প্রদর্শিত হতে পারে।
  • নিরন্তর দুর্বলতা ও ক্লান্তি অনুভব।

রোগের বিভিন্ন পর্যায়ে উপসর্গ

লিউকেমিয়ার উপসর্গগুলি রোগের পর্যায় অনুযায়ী গুরুতরতা ও প্রকারে ভিন্ন হয়। তীব্র লিউকেমিয়ায় এই উপসর্গগুলি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং তীব্র হতে পারে, যেখানে দীর্ঘস্থায়ী লিউকেমিয়া হলে এগুলি ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। প্রারম্ভিক পর্যায়ে, রোগী স্বাভাবিক বোধ করতে পারে, কিন্তু সংক্রমণ এবং রক্তক্ষরণ ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

লিউকেমিয়ার প্রকারভেদ

লিউকেমিয়া রোগের বিভিন্ন ধরণ ও তাদের প্রকৃতি বিশেষ নির্ণায়নে সহায়ক হয় চিকিৎস পরিকল্পনায়। এর মূল বিভাজনে আমরা দেখতে পাই অ্যাকিউট লিউকেমিয়া এবং ক্রনিক লিউকেমিয়া, যেখানে রোগের প্রকোপ ও চরিত্র নির্ভর করে রক্তকণিকার উপাদানের উপর।

অ্যাকিউট (তীব্র) লিউকেমিয়া

অ্যাকিউট লিউকেমিয়াতে রোগীর অপরিণত রক্তকণিকা অতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা মারাত্মক হতে পারে। খুব কম সময়ের মধ্যেই এর লক্ষণগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। অ্যাকিউট মায়লোজেনাস লিউকেমিয়া (AML) এবং অ্যাকিউট লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া (ALL) এ দুই প্রধান প্রকারের অ্যাকিউট লিউকেমিয়া।

ক্রনিক (দীর্ঘস্থায়ী) লিউকেমিয়া

ক্রনিক লিউকেমিয়া, বিপরীতভাবে, ধীরে ধীরে তার প্রকোপ বাড়ায়। রোগীরা অনেক সময় দীর্ঘদিন ধরে কোনো লক্ষণ ছাড়াই জীবনযাপন করতে পারেন। ক্রনিক মায়লোজেনাস লিউকেমিয়া (CML) এবং ক্রনিক লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া (CLL) এ দুই প্রধান ধরণের ক্রনিক লিউকেমিয়া।

আরও পড়ুনঃ  গর্ভাবস্থায় কত মাসে পেট বড় হয়

লিউকেমিয়ার অন্যান্য প্রকার

উপরোক্ত বিভাগ ছাড়াও, লিউকেমিয়া বিশেষ করে লিম্ফোসাইটিক এবং মায়লোজেনাস উপ-প্রকারে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়ে থাকে, যা লিম্ফোয়েড বা মায়েলোয়েড কোষগুলি কীভাবে প্রভাবিত করে তার উপর নির্ভর করে।

লিউকেমিয়া কিভাবে নির্ণয় করা হয়?

লিউকেমিয়ার নির্ণয় প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন ধরনের মেডিকেল টেস্ট ও পরীক্ষার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। এই পরীক্ষাগুলির মাধ্যমে চিকিৎসকরা রোগীর শারীরিক অবস্থা ও রোগের গভীরতা নির্ণয় করতে পারেন, যা রক্ত পরীক্ষা এবং অস্থি মজ্জা বায়োপসি পরীক্ষাগুলির মাধ্যমে সম্ভব।

মেডিকেল টেস্টের গুরুত্ব

রক্ত পরীক্ষাগুলি চিকিৎসকদের রক্তের বিভিন্ন কম্পোনেন্ট যেমন শ্বেতকণিকা, রক্তবর্ণকণিকা, এবং প্লেটলেট এর সংখ্যা ও গুণমানের নির্ণয়ের পদ্ধতি নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। এর ফলে, রক্তের অস্বাভাবিকতা সনাক্ত করা সহজ হয়, যা লিউকেমিয়ার লক্ষণ হতে পারে।

চিকিৎসকের ভূমিকা

চিকিৎসকেরা প্রায়ই অস্থি মজ্জা বায়োপসি পরীক্ষাটি সুপারিশ করেন, যা অস্থি মজ্জা থেকে কোষ নমুনা সংগ্রহ করে এবং মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে পরীক্ষা করা হয়। এই পদ্ধতিটি ক্যান্সারীয় কোষের উপস্থিতি নির্ধারণে অত্যন্ত সহায়ক।

লিউকেমিয়ার চিকিৎসা পদ্ধতি

লিউকেমিয়ার চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রধানত তিনটি চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত: কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি এবং হেমাটোপয়েটিক প্রতিস্থাপন। এসব চিকিৎসা পদ্ধতি রোগীর ক্যান্সারের স্টেজ এবং তাঁর সাধারণ স্বাস্থ্যের অবস্থা অনুযায়ী নির্বাচন করা হয়।

রসায়নিক থেরাপি

এই পদ্ধতিতে, ক্যান্সার বিনাশক ওষুধ এবং রাসায়নিক পদার্থসমূহ রোগীর শরীরে প্রবেশ করিয়ে ক্যান্সার কোষগুলিকে ধ্বংস করা হয়। এটি উপশম চিকিৎসা হিসেবেও পরিচিত, যা ক্যান্সারের বিস্তার রোধ করতে এবং রোগীর জীবনমান উন্নত করতে সাহায্য করে।

রেডিয়েশন থেরাপি

এই পদ্ধতিতে উচ্চ শক্তির রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয় যা সরাসরি ক্যান্সার কোষ এবং টিউমারের উপর প্রয়োগ করে। রেডিয়েশন থেরাপি ক্যান্সারের কোষগুলিকে বিভক্ত হতে বাধা দেয় এবং ধীরে ধীরে তাদের মৃত্যু ঘটায়।

স্টেম সেল ট্রান্সপ্ল্যান্ট

এটি একটি উন্নত এবং জটিল চিকিৎসা পদ্ধতি, যা প্রধানত হেমাটোপয়েটিক প্রতিস্থাপন নামে পরিচিত। এতে রোগীর অস্থি মজ্জার ড্যামেজ হওয়া স্টেম সেলগুলি স্বাস্থ্যকর স্টেম সেল দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীর অস্থি মজ্জার স্বাভাবিক ফাংশন পুনরায় সক্রিয় করা সম্ভব হয়।

আরও পড়ুনঃ  মাথা ঘোরা বন্ধ করার উপায় জানুন

জীবনযাত্রায় পরিবর্তন

লিউকেমিয়া শুধু একটি চিকিৎসাগত চ্যালেঞ্জ নয়, এটি জীবনধারার পরিপূর্ণ পরিবর্তনে পরিচয় বয়ে আনে। এই পরিবর্তনগুলি দেহের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ স্থাপনে এবং চিকিৎসাকে আরো কার্যকর করে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। লিউকেমিয়া জীবনযাত্রা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস তৈরিতে বিশেষজ্ঞরা অপ্রতিবিদ্ধ।

স্বাস্থ্যকর ডায়েট

একটি ব্যালান্সড এবং পুষ্টিকর ডায়েট লিউকেমিয়ার জীবনে একটি পিলার হিসেবে কাজ করে। অধিকাংশ চিকিৎসকেরা এমন খাদ্য পরামর্শ দেন যা রোগীর ইমিউন সিস্টেমকে বলিষ্ঠ করে এবং চিকিৎসাজনিত ক্লান্তিকে হ্রাস করে। শাকসবজি, ফলমূল, সম্পূর্ণ শস্য, এবং প্রোটিনযুক্ত খাবার যেমন ডিম, মাংস এবং ফলিত শস্য এই দীর্ঘ যাত্রায় শরীরের পক্ষে শক্তির উৎস হতে পারে।

নিয়মিত শরীরচর্চার গুরুত্ব

লিউকেমিয়া আক্রান্ত রোগীদের জন্য নিয়মিত শারীরিক কসরত অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। একটি নিয়মিত ওয়ার্কআউট রুটিন শরীরের দৃঢ়তা এবং প্রচুরতা বজায় রাখে, যা চিকিৎসার সাইড ইফেক্ট কমিয়ে এনে চিকিৎসার সাড়াকে উন্নত করতে পারে। নিয়মিত হাঁটা, হালকা যোগ, সাঁতার বা যে কোনো ধরনের ক্রীড়া শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মানসিক স্বাস্থ্য সঠিক রাখতে সাহায্য করে।

এ ধরনের আরো আর্টিকেল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button